ব্যবসায়ের উৎপত্তির মূলে ছিল মানুষের অভাববোধ। অভাব পূরণের লক্ষ্যেই মানুষ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উপার্জন প্রচেষ্টায় জড়িত হয়। মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও লেনদেনকে ঘিরেই উদ্ভব হয় ব্যবসায়ের। এ অধ্যায় থেকে আমরা ব্যবসায়ের ধারণা, উৎপত্তি, বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ ও ব্যবসায়িক পরিবেশসহ বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারব।
এ অধ্যায় শেষে আমরা :
ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষক জনাব আসাদুজ্জামান নবম শ্রেণির ব্যবসায় উদ্যোগ বিষয়ের প্রথম ক্লাসে আসলেন। শিক্ষার্থীরা তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাল। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তিনি শিক্ষার্থীদের সকলের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে কে ব্যবসায়ী পরিবার থেকে এসেছ?' একজন শিক্ষার্থী বলল, তার বাবার চালের ব্যবসায় আছে। আরেকজন শিক্ষার্থী বলল, তার বাবার হাঁস-মুরগির খামার আছে। আরেকজন শিক্ষার্থী বলল, তার বাবার ঔষধের দোকান আছে। অন্য একজন শিক্ষার্থী বলল, তার মায়ের একটি বিউটি পার্লার আছে। শিক্ষক সকলের কথা মন দিয়ে শুনলেন এবং বললেন ধান-চাল, হাঁস-মুরগি ও ঔষধ বিক্রয় এবং বিউটি পার্লার পরিচালনা করা প্রত্যেকটি এক একটি অর্থনৈতিক কাজ। তোমাদের অভিভাবকদের সবগুলো অর্থনৈতিক কাজ ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত হবে যদি তারা জীবিকা নির্বাহ ও মুনাফার আশায় উক্ত কাজগুলো করে থাকেন।
সাধারণভাবে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যবসায় বলে। পরিবারের সদস্যদের জন্য খাদ্য উৎপাদন করা, হাসঁ-মুরগি পালন করা, সবজি চাষ করাকে ব্যবসায় বলা যায় না। কিন্তু যখন কোনো কৃষক মুনাফার আশায় ধান চাষ করে বা সবজি ফলায় তা ব্যবসায় বলে গণ্য হবে। তবে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যবসা বলে গণ্য হবে যদি সেগুলো দেশের আইনে বৈধ ও সঠিক উপায়ে পরিচালিত হয়।
ব্যবসায়ের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা একে অন্য সব পেশা থেকে আলাদা করেছে। ব্যবসায়ের সাথে জড়িত পণ্য বা সেবার অবশ্যই আর্থিক মূল্য থাকতে হবে। ব্যবসায়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এর সাথে ঝুঁকির সম্পর্ক। মূলত মুনাফা অর্জনের আশাতেই ব্যবসায়ী অর্থ বিনিয়োগ করে। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি অবশ্যই সেবার মনোভাব থাকতে হবে। ব্যবসায়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এতে নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনা করতে হয়।
দিনে দিনে মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আওতাও বাড়তে থাকে। ফলে শুরু হয় পশু শিকার, খাদ্যশস্য উৎপাদন ও পণ্য বিনিময়ের মতো কর্মকাণ্ড। কিন্তু পণ্য বা দ্রব্য বিনিময় করেও প্রয়োজন মেটানো যায় নি। ফলে দ্রব্য বিনিময়ের স্থলে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণ-রৌপ্যের মুদ্রা ও পরবর্তীকালে কাগজি মুদ্রার প্রচলন হয়। ব্যবসায়ের ক্রমবিকাশের এ ধারাকে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগ এই তিন পর্যায়ে বিভক্ত করা যায় ৷
ব্যবসায়ের ক্রমবিকাশের ধারা
প্রাচীন যুগ | মধ্য যুগ | আধুনিক যুগ |
|
|
|
বর্তমানে ব্যবসায় শুধু পণ্যদ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পণ্য-দ্রব্য ও সেবাকর্ম উৎপাদন, পণ্য-দ্রব্য বিনিময় ও এর সহায়ক কাজের সমষ্টিকে ব্যবসায় বলে। পণ্য-দ্রব্য বিনিময় সংক্রান্ত সহায়ক কাজে পরিবহন, বিমা, ব্যাংকিং, গুদামজাতকরণ ও বিজ্ঞাপন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক ব্যবসাকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
ক. শিল্প (Industry)
খ. বাণিজ্য (Commerce)
গ. প্রত্যক্ষ সেবা (Direct Services)
শিল্প (Industry)
শিল্পকে উৎপাদনের বাহন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, কাঁচামালে রূপদান এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কাঁচামালকে মানুষের ব্যবহার-উপযোগী পণ্যে পরিণত করা হয় তাকে শিল্প বলা হয়। শিল্পকে প্রধানত পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
বাণিজ্য (Commerce)
বাণিজ্যকে ব্যবসায়ের পণ্য বা সেবা সামগ্রী বণ্টনকারী শাখা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ব্যবসায় বা শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল উৎপাদকের নিকট পৌঁছানো কিংবা শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বা সেবা সামগ্রী ভোক্তাদের নিকট পৌছানোর সকল কার্যাবলিকে বাণিজ্য বলে। পণ্য-দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় কার্য যথার্থভাবে সমাধানের ক্ষেত্রে অর্থগত, ঝুঁকিগত, স্থানগত, কালগত ও তথ্যগত বাধা বা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সকল বাধা দূরীকরণে বাণিজ্যের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন পরিবহন, গুদামজাতকরণ, ব্যাংকিং, বিমা, বিপণন ও বিজ্ঞাপন ইত্যাদির সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। বাণিজ্যকে আধুনিককালে ব্যবসায় টু ব্যবসায় (Business to Business ) বলেও অভিহিত করা হয়।
নিম্নে বাণিজ্যের বিভিন্ন উপাদানের ভূমিকা ছকে প্রদর্শন করা হলো—
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বাধা | বাণিজ্যের উপাদান | ভূমিকা |
স্বত্বগত | পণ্য বিনিময় | মালিকানাসংক্রান্ত বাধা দূর করে |
স্থানগত | পরিবহন | স্থানগত বাধা দূর করে |
সময়গত | গুদামজাতকরণ | সময়গত বাধা দূর করে |
অর্থগত | ব্যাংকিং | অর্থ সংক্রান্ত বাধা দূর করে |
ঝুঁকিগত | বিমা | ঝুঁকিসংক্রান্ত বাধা দূর করে |
তথ্যগত | বিজ্ঞাপন | তথ্য ও প্রচার সংক্রান্ত বাধা দূর করে |
প্রত্যক্ষ সেবা (Direct Services)
অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত ডাক্তার, উকিল, প্রকৌশলী প্রভৃতি পেশাজীবীরা বিভিন্ন রকম সেবাকর্ম অর্থের বিনিময়ে প্রদান করে থাকেন। এ সকল সেবাকর্ম বা বৃত্তি প্রত্যক্ষ সেবা হিসেবে পরিচিত। যেমন ডাক্তারি ক্লিনিক, আইন চেম্বার, প্রকৌশলী ফার্ম,অডিট ফার্ম ইত্যাদি। প্রত্যক্ষ সেবা আধুনিক ব্যবসায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য হলেও ব্যবসায় যে কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক তথা সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। ব্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই গড়ে উঠেছে ছোট-বড় দোকান থেকে শুরু করে বিশাল শিল্প কারখানা। বর্তমান বিশ্বে ব্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। আজকের পৃথিবীতে সে সকল দেশ উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করছে যে দেশগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নত। ব্যবসায়ের মাধ্যমে সম্পদের যথাযথ ব্যবহার সহজ হয় এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। ব্যবসায়ের ফলে সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়, মূলধন গঠিত হয় ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়। ব্যবসায়ের মাধ্যমে বেকার মানুষের কর্মসংস্থান হয় ব্যবসায় গবেষণা ও সৃজনশীল কাজের উন্নয়ন ঘটায়। ব্যবসায়-বাণিজ্যের ফলে দেশে-দেশে পণ্য-দ্রব্যের আদান প্রদানের সাথে সাথে সংস্কৃতির বিনিময়ও ঘটে। ব্যবসায়-বাণিজ্যকে ঘিরে নতুন-নতুন শহর, বন্দর গড়ে উঠে।
পরিবেশ দ্বারা মানুষের জীবনধারা, আচার-আচরণ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং ব্যবসা প্রভাবিত হয় । পরিবেশ হলো কোনো অঞ্চলের জনগণের জীবনধারা ও অর্থনৈতিক কার্যাবলিকে প্রভাবিত করে এমন সব উপাদানের সমষ্টি। পারিপার্শ্বিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, নদ-নদী, পাহাড়, বনভূমি, জাতি, ধর্ম, শিক্ষা ইত্যাদি। যে সব প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক উপাদান দ্বারা ব্যবসায়িক সংগঠনের গঠন, কার্যাবলি, উন্নতি ও অবনতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয় সেগুলোর সমষ্টিকে ব্যবসায়িক পরিবেশ বলে। কোনো স্থানের ব্যবসায়-ব্যবস্থার উন্নতি নির্ভর করে ব্যবসায়িক পরিবেশের উপর।
বহু প্রকারের ব্যবসায়িক পরিবেশ দেখতে পাওয়া গেলেও ব্যবসায়িক পরিবেশের উপাদানগুলোকে প্রধানত ছয় ভাগে ভাগ করা যায় ৷
ক. প্রাকৃতিক পরিবেশ (Natural environment)
খ. অর্থনৈতিক পরিবেশ (Economic environment)
গ. রাজনৈতিক পরিবেশ ( Political environment
ঘ. সামাজিক পরিবেশ (Social environment)
ঙ. আইনগত পরিবেশ(Legal environment)
চ. প্রযুক্তিগত পরিবেশ (Technical environment)
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর উন্নয়নশীল দেশ। অবশ্য দেশের অর্থনীতিতে ব্যবসায় তথা শিল্প ও বাণিজ্যের অবদান প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। এক কালে এ অঞ্চল ব্যবসায়-বাণিজ্যে সারাবিশ্বে বিখ্যাত ছিল। ব্যবসায়- বাণিজ্যে প্রসিদ্ধ স্থান হিসেবে বিশেষ করে মসলিন কাপড়ের জন্য ‘সোনারগাঁও' এবং সমুদ্র বন্দর ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য ‘চট্টগ্রাম’, এ দুটো স্থানের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। সোনারগাঁও এবং এর আশেপাশে তৈরি মসলিন রফতানি হতো ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। আমাদের দেশ চিরকাল বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। এ দেশের বাণিজ্যের খ্যাতিতে প্রলুব্ধ হয়ে আরবগণ স্মরণাতীত কাল পূর্বে থেকে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং দলে দলে এদেশে আগমন করেন। বাণিজ্য বিষয়ে তখন এ অঞ্চলের শ্রীবৃদ্ধি এতদূর হয়েছিল যে, ইতিহাস বিখ্যাত তাম্রলিপ্ত ও সপ্তগ্রামের সাথে এর ঘোর প্রতিযোগিতা চলত। এ অঞ্চলের বাণিজ্য খ্যাতি প্রাচ্যের দেশ ছাড়িয়ে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। খ্রিস্ট্রীয় ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা এসে বাণিজ্য করতে আরম্ভ করেন। তারা সপ্তগ্রামকে Porto Piqueno বা ক্ষুদ্র বন্দর এবং চট্টগ্রামকে Porto Grando বা বৃহৎ বন্দর নামে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য, বাণিজ্য বন্দর হিসেবে পশ্চিম বঙ্গের সপ্তগ্রাম নামটিও বিখ্যাত ছিল। ভাগীরথী নদী ও সরস্বতী খালের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের সাথে সপ্তগ্রামের বাণিজ্য চলত। সমুদ্র পথে ব্যবসায়ের জন্যও আমাদের দেশ প্রসিদ্ধ ছিল। সমুদ্রগামী জাহাজও এ দেশে নির্মিত হতো। চৈনিক পরিব্রাজক মাহুয়ান লিখেছেন যে, এ দেশের জাহাজ নির্মাণ প্রণালির শ্রেষ্ঠত্ব হৃদয়ঙ্গম করে মহামান্য রোমের সম্রাট আলেকজান্ড্রিয়ার ডক কারখানা ও জাহাজ পছন্দ না করে চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ তৈরি করে নিতেন। চট্টগ্রামের হালিশহর, পতেঙ্গায় দেশীয় শিল্পীর কর্তৃত্বে অনেকগুলো জাহাজ নির্মাণ কারখানা ছিল। ঐ সকল কারখানা তখন হাতুড়ির ঠক্ঠক্ শব্দে সবসময় মুখরিত থাকত। এ দেশের সওদাগরেরা তখন শতাধিক জাহাজের মালিক ছিলেন। ইতিহাসবিদ ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, ঐ সকল জাহাজ নির্মাণ কারখানা ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নিজেদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ব্যবসায়িক পরিবেশের সকল উপাদান অনুকূল না হলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে উন্নতি লাভ করে টিকে থাকা কঠিন। নিম্নে ব্যবসায়িক পরিবেশের উপাদানগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা হলো ।
প্রাকৃতিক উপাদান : প্রাকৃতিক পরিবেশের অধিকাংশ উপাদানই বাংলাদেশে ব্যবসায় স্থাপনের জন্য অনুকূল। দেশের প্রায় সকল অংশই নদী বিধৌত। ফলে সহজেই এখানে কৃষিজাত বিভিন্ন শিল্প ও ভোগ্য পণ্যের কাঁচামাল উৎপাদন করা সম্ভব। ব্যবসায় বা শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যমান। দেশে বিদ্যমান খনিজ কয়লা, চুনা পাথর, কঠিন শিলা ও খনিজ তৈল শিল্প বিকাশে সহায়ক। দিন দিন বনভূমির পরিমাণ কমে গেলেও আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ বনজ সম্পদ। অসংখ্য নদী বিধৌত ও সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় মৎস্য শিল্প বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশও এখানে বিদ্যমান ।
অর্থনৈতিক উপাদান : দেশে বিরাজমান কার্যকর অর্থ ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা, কৃষি ও শিল্পের অবদান, জনগণের সঞ্চয় ও বিনিয়োগ মানসিকতা ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবসায় পরিবেশের সুদৃঢ় অর্থনৈতিক উপাদান হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উপাদানগুলোর কয়েকটির ভিত্তি বেশ মজবুত হলেও অনেকগুলোর ভিত্তি তেমন সুদৃঢ় নয়। চাহিদার তুলনায় প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব, গ্রামীণ জনগণের ব্যাংকিং সেবা ও ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শহরের তুলনায় কম সুবিধা, প্রশাসনিক জটিলতা, দালাল শ্রেণির লোকদের হয়রানি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি প্রতিকূল অবস্থা কাটাতে পারলে বাংলাদেশ ব্যবসায় বিকাশে আরও দ্রুত অগ্রসর হতে পারবে।
সামাজিক উপাদান : জাতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, ভোক্তাদের মনোভাব, মানব সম্পদ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রভৃতি ব্যবসায়ের সামাজিক উপাদানগুলোর বেশিরভাগ বাংলাদেশে ব্যবসায় প্রসারের ক্ষেত্রে অনুকূল। এ দেশের মানুষ জাতিগত, ঐতিহ্যগত এবং সাংস্কৃতিকভাবে উদার, পরিশ্রমী এবং সৃজনশীল। অতীতে জাহাজ নির্মাণ করে এবং মসলিন কাপড় উৎপাদন করে এ দেশের মানুষ তাদের প্রতিভা ও পরিশ্রমের স্বাক্ষর রেখেছে। সোনারগাঁও এক সময় ব্যবসায়, শিক্ষা-দীক্ষা, কৃষি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, কারু শিল্পে ছিল বিশ্বসেরা। বর্তমানেও জামদানি শাড়ি তৈরি এবং জাহাজ নির্মাণ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুখস্থ নির্ভরতা থেকে বের করে আরও দক্ষতা ও শ্রমনির্ভর করতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিল্প, বাণিজ্য, গবেষণায় আরও বেশি সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে পারবে। সাথে সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বৃদ্ধি করতে হবে।
রাজনৈতিক উপাদান : সুষ্ঠু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং অনুকূল শিল্প ও বাণিজ্যনীতি, প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশের সাথে সুসম্পর্ক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে সহায়তা করে। অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, হরতাল, ধর্মঘট, ব্যবসায়-বান্ধব শিল্প ও বাণিজ্য নীতির অভাব ইত্যাদি প্রতিকূল রাজনৈতিক উপাদান শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারে বাধা সৃষ্টি করে। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীগণও বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয় না। বাংলাদেশে ব্যবসায়ের উক্ত রাজনৈতিক উপাদানের সবগুলো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বিদ্যমান নেই। শ্রমিক অসন্তোষ, ধর্মঘট, হরতালসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিহার করার মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্যবসায়ের জন্য রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নত করা যায় ৷
আইনগত উপাদানঃ আইনগত পরিবেশের বেশ কিছু উপাদান বাংলাদেশে আধুনিক ও যুগোপযোগী হলেও অনেকগুলো বেশ পুরাতন। পরিবেশ সংরক্ষণ ও ভোক্তা আইনের কঠোর প্রয়োগ, শিল্প ও বিনিয়োগ বান্ধব আইন তৈরি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের ব্যবসা- বাণিজ্যের উন্নতি নিশ্চিত করা যায়।
প্রযুক্তিগত পরিবেশ : শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের উন্নতিতে দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী, উন্নত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়। সাধারণত দেখা যায়, যে সকল দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবেশে উন্নত তারা ব্যবসা- বাণিজ্যেও উন্নত। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সহজতর করে। ফলে উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশের প্রযুক্তিগত উপাদানগুলো অনেকক্ষেত্রেই অনুকূল। ব্যবসায়ের সকল শাখায় প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভাব বিস্তারকারী পরিবেশগত উপাদানসমূহের উন্নয়ন খুবই জরুরি। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প উন্নয়নে অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।